করোনা ও আমার অভিজ্ঞতা,corona,covid19
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে এক ভাইরাসের উৎপত্তি হয়, নাম তার করোনা বা কোভিড-১৯ ভাইরাস। যদিও বেশিরভাগ ভাইরাস ই চীন থেকে প্রাদুর্ভাব ঘটে। বর্তমান ভাইরাসের জন্য এখন গোটা বিশ্ব আতঙ্কিত। কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না প্রাণঘাতি এই ভাইরাস। বিভিন্ন দেশের বড় বড় বিজ্ঞানীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শতভাগ কার্যকরী কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা বের করার জন্য । এখন পর্যন্তও বেড়েই চলেছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। প্রথম দিকে ভেবেছিলাম চীন অনেক দূর। আমাদের এখানে তেমন কিছু করতে পারবে না।যেহেতু সার্স, মার্স, বিভিন্ন ফ্লু ভাইরাসের উৎপত্তি চীনেই তবু আমাদের দেশে তেমন ক্ষতি করতে পারিনি।যদিও এই ভাইরাস সার্স গোত্রের। বাংলাদেশে ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। তবুও মনে তেমন একটা ভয় ঢুকেনি। ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা হয়। ১৮ মার্চ ঢাকা থেকে বাড়ি আসি। বাড়ি এসেই আমার ভাগ্য খুব একটা সুপ্রসন্ন হলো না। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমার একবার চিকন গুনিয়া হয়েছিল। কি ব্যাথা! যার হয়েছিল সেই বুঝে। ২৪ মার্চ আমার জ্বর হয়, সাথে তীব্র পেশী ব্যাথাও শুরু হয়। আমি ভাবলাম, চিকন গুনিয়া আবার হলো। তবু মনের মধ্যে একটু ভয় কাজ করে। নতুন ভাইরাস ধরলো না তো। সারাক্ষণ রুমের মধ্যেই থাকি। কাউকে বুঝতে দেয় না। ২৫ মার্চ রাতে ফেসবুকে একটি সচেতনমূলক পোস্ট দেয় যেন কারো জ্বর সর্দি হলে কয়েকদিন একা অবস্থান করে। যাকে হোম কোয়ারান্টাইন বলে। পোস্টে আমি হোম কোয়ারান্টাইনে আছি এটা দেখে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পূর্বপরিচিত এক ডাক্তার ও আমার বাল্যকালের ফার্মাসিস্ট এক বন্ধুর পরামর্শে কিছু ঔষধ খেতে থাকি। অবশেষে আল্লাহর রহমত ও সবার দোয়ায় ২৬ মার্চ সকালেই জ্বর ভালো হয়। তবু আমি বাড়ির বাইরে বের হয়না। ঐদিনই দুপুর ২ঃ৩০ টার দিকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছি। এসময় আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় বেশ কিছু লোকের সমাগম দেখতে পাই। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলাম, আমাদের ইউনিয়নের একজন চৌকিদার এসেছে। পরে সেখানে গিয়ে শোনলাম, আমাকে দেখতে আসছে। এলাকার কে যেন ইউ এন ও কে ফোন দিয়ে জানিয়েছে আমার করোনা হয়েছে। আমাকে নিয়ে নাকি থানায় মিটিংও হয়েছে (চৌকিদারের ভাষ্য)। চৌকিদার আমার অবস্থা ভালো দেখে ইউ এন ও এর সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন। চলে যাবার সময় বলে গেলেন, বিকালে একটু ঘুরাঘুরি করতে যেন এলাকার লোকজন আমাকে দেখে তাদের সন্দেহ দূর হয়। চৌকিদারের কথায়, বিকালের দিকে একটু বের হলাম। বের হয়ে আমি নিজেই অবাক। যেই দেখে সেই বলে আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এদিকে আমার পরিবারের লোকজন বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। সবাই বলাবলি করছে, করোনার জন্য আমাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। পরে বুঝতে পারলাম, গ্রামের মানুষ গুলো চৌকিদারকে পুলিশ ভেবেছে। সচেতনমূলক পোস্ট দেয়ার জন্য এতটা হয়রানির মুখে পড়তে হবে বুঝতে পারিনি। এ যেন খাল কেটে কুমির ডেকে আনার মতো কাহিনী ঘটে যায় আমার সাথে। এরপর থেকেই আমি অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকি। এ মহামারী থেকে পৃথিবী কবে মুক্তি পাবে, ফিরে আসবে স্বাভাবিক জীবন। করোনার প্রথমদিকে দেশে একদিনে শনাক্তের সংখ্যা ছিল ৩ জন। এখন একদিনে শনাক্তের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। আল্লাহ পাক ই ভালো জানেন, আমাদের সামনে কি হবে। প্রতিটা সময় স্বাভাবিক খবর শোনার জন্য ওয়ার্ল্ডোমিটার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২ঃ৩০টার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সরাসরি সম্প্রচারিত খবর দেখতে থাকি। এ যেন এখন এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। কিছু কিছু দেশের করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসার খবরে সামান্য ভালো লাগা কাজ করে। কিন্তু ২ঃ৩০টার খবরে যখন স্বদেশের করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়ার খবর শুনি, সেই ভালো লাগা উধাও হয়ে হতাশায় পরিণত হয়। প্রথম দিকে আক্রান্তের সংখ্যা কম হলেও সচেতনতা বেশি ছিল। এখন আক্রান্তের সংখ্যা বেশি,কিন্তু সচেতনতা কম। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, গ্রামের মানুষগুলো সচেতনতার জন্যই ইউএনও কে ফোন দিয়েছিল। এখনও আল্লাহর রহমতে আমাদের গ্রামে কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়নি। একদিন আল্লাহর রহমতে আমরা করোনা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কখনো ভুলতে পারবো না। দোয়া করি, আল্লাহ যেন খুব শীঘ্রই পৃথিবীর বুক থেকে করোনা নামক মহামারী তুলে নেয়। আর যেন এমন ভয়ানক বিপদ না দেয়। তবুও আমরা সবাই আশাবাদী, বেঁচে থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য সোনালী দিন আসবেই। কিন্তু আমাদের সচেতন থাকতে হবে। সবাই সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন, বেশি বেশি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করুন (আমিন)। মোঃ মনিরুল ইসলাম, প্রভাষক, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়।
COMMENTS